পুজোর ঢাকে কাঠি পড়লে কার না মন চায় দূরে কোথাও কয়েকদিনের জন্য বেরিয়ে আসতে? কিন্তু সুচরিতার কখনোই সেই সৌভাগ্য হয় না। কেন? তার বাবা যে একজন পুলিশ! পুলিশরা কি পুজোর সময় ছুটি পায় নাকি? মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সায়ন্তনের খুব মন খারাপ, পরীক্ষার সময় সবার মায়েরা তার সন্তানদের পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিতে এলেও তার মায়ের কখনোই সেই সুযোগ হয় না। কেন? তার মা যে মহিলা পুলিশের একজন আধিকারিক, তাই সন্তানের পরীক্ষার সময় তাঁর ছুটি মেলে না। অন্তঃসত্ত্বা তানিয়ার প্রসবের সময় এগিয়ে আসছে, এই সময় স্বামীকে কোন মেয়েরা না পাশে চায়? তানিয়াকে যদিও দাঁতে দাঁত চেপে যখন প্রসব বেদনাটাকে সহ্য করতে হয়েছিল, তখন তার স্বামী ব্যস্ত তাঁর পুলিশি কর্তব্যে। মৃত্যুপথযাত্রী পিতার কপালে নীরবে হাত বুলিয়ে দিয়ে থানার পথে অগ্রসর হন কাকলি, তিনি জানেন ও না তিনদিন পর ডিউটি সেরে বাসায় ফিরে আসার পর তাঁর পিতাকে আর দেখতে পাবেন কিনা। আজ থেকে এক বছর পূর্বে তৃপ্তির সিঁথি থেকে সিঁদুরের রেখাটুকু চিরতরে মুছে গেছে। তাঁর স্বামী একজন নির্ভিক, কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিক রূপে এক অভিযান চালাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তখন তাঁদের দুই মাসের শিশু সন্তান বর্তমানে সবেমাত্র কথা বলতে শিখেছে, অস্ফুট স্বরে বাবা ডাকতে পারে সে এখন, কিন্তু কাকে আর সে বাবা বলে ডাকবে? নন্দিনীর বহু বছরের প্রেমের সম্পর্কটা পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি, কারণ তার রক্ষণশীল পিতা কন্যাকে কিছুতেই ‘ঘুষখোর’ (তাঁর ভাষায়) খাকি উর্দিধারীর হাতে তুলে দিতে রাজি ছিলেন না। হ্যাঁ, সুচরিতা, সায়ন্তন, তানিয়া, কাকলি. তৃপ্তি, নন্দিনী-এই নামগুলো হয়তো আক্ষরিক অর্থে কাল্পনিক, কিন্তু আমরা আমাদের চারপাশে অনেক বাস্তব চরিত্রকে খুঁজে পাব, যাদের মধ্যে এক মানুষগুলোই লুকিয়ে আছে। নীরবে আমাদের নিরাপত্তাটুকু সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে যাঁরা তাঁদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সময়টুকু দেবার ফুরসৎ পান না, যাঁদের পৃথিবীটা শুধু দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধের বন্ধনীর মধ্যেই আটকে থাকে সারাজীবনের জন্য, তাদের সম্বন্ধে আমরা ঠিক কতটুকুই বা জানি?
তবু পুলিশ-শব্দটার মধ্যে আমাদের কতই না কৌতূহল লুকিয়ে আছে, তারা আমাদের কারোর সন্তান, কারোর ঘরের লোক হয়েও যেন কত অপরিচিত। অনেকে এই শব্দটার আড়ালে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর একদল মানুষকে কল্পনা করে নেয়, আর অনেকে মনে করেন এই পেশার মানুষজনের মধ্যে বোধ হয় সততার লেশ মাত্র নেই। জানিনা, তাদের মনের মধ্যে এই ধরনের ধারণার কারণটা কি। পৃথিবীর বহু দেশে পুলিশদের যতটা শ্রদ্ধা, সম্মানের চোখে দেখা হয়, ভারতবাসীরা কোন এক অজ্ঞাত কারণে বোধহয় এখনো এই পেশার মানুষজনকে ততখানি আপন বলে ভাবতে পারেননি। কেন? তার উত্তর সত্যি আমাদের সবারই অজানা। আমরা এক বর্ষবরণের রাতে বাপী ঘোষ নামে এক পুলিশি উর্দিধারী মহান মানুষের নিজের প্রানের বিনিময়ে নারীর সম্মান রক্ষার ইতিহাস ভুলে যেতে পারি, আমরা গার্ডেনরিচে নির্ভীক সাহসী পুলিশ অফিসার বিনোদ মেহেতার আত্মত্যাগের ঘটনাকেও ভুলে যেতে পারি, আমরা ভুলে যেতে পারি নির্ভীক চিত্ত পুলিশ আধিকারিক গঙ্গাধর ভট্টাচার্যের মর্মস্পর্শী পরিণতির কথা। তবু পুলিশের কথা উঠলে হয়তো ‘এরেস্ট’, ‘থার্ড ডিগ্রি’, ‘এনকাউন্টার’ শব্দগুলো সবার পূর্বে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? কেন আমরা বারংবার পুলিশের মানবিক সত্তাটাকে ভুলে গিয়ে তাদের শুধুমাত্র নিষ্ঠুর, নির্মম, বর্বর ভেবে পরিতৃপ্তি লাভ করে থাকি?
বাংলা সাহিত্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রাত্যই রয়ে গেছে শান্তিরক্ষী বাহিনী। পুলিশের চরিত্র নিয়ে সাহিত্য খুব কমই লেখা হয়েছে, আর যেটুকু লেখা হয়েছে, তার মধ্যে দু-একটা ব্যতিক্রমধর্মী পুস্তক বাদে পুলিশের মানবিক রূপটাকে ফুটিয়ে তুলতে লেখকরা বড় একটা আগ্রহ দেখাননি। তাই আমাদের এই প্রয়াসটি আক্ষরিক অর্থেই খানিকটা স্বকীয়তার দাবি রাখে। একজন পুলিশ অফিসারের কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবন অবলম্বনে রচিত এই উপন্যাসের পাতায় এমন একজন মানুষকে আপনারা খুঁজে পাবেন যিনি ‘ভিনগ্রহের প্রাণী’র স্থানে সর্বাগ্রে রক্তমাংসের একজন সমব্যাথী, স্বহৃদয়, কর্তব্যনিষ্ঠ কোমলে কঠোর মানুষ। এখানে তাঁর কর্মজীবনের বহু মামলার তদন্তকে প্রায় অবিকৃতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তুলে ধরা হয়েছে সুক্ষ বুদ্ধি ও বিচক্ষনতার দ্বারা বহু রহস্যের সমাধানের ঘটনাগুলোকে, যা কল্পনার থেকেও বোধহয় কোন অংশে কম রোমহর্ষক নয়।
হ্যাঁ, অরিন্দম ভট্টাচার্য (উপন্যাসের কাহিনীতে) এমনই একজন পুলিশ আধিকারিক, যিনি অসহায় মানুষের বেদনায় সহৃদয় সমব্যথী হলেও, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই এর আঙিনায় তার চোখের জ্বলে ওঠে আগুন। নিষ্ঠুর এনকাউন্টারে তখন হাত কাঁপে না এই কর্তব্যে অবিচল অফিসারের। আবার অন্ধকার জগতের কোন ব্যক্তি আলোয় ফিরতে চাইলে তিনি তাদের দিকে বন্ধুর মত বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে একরাশ শূন্যতা আর বেদনায় বারংবার জর্জরিত হতে হয়েছে তাঁকে। কারণ প্রদীপের আলোকের নিচেই যে অন্ধকারের আনাগোনা। হ্যাঁ, উপন্যাসের স্বার্থে হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, সেই সাথে পরিবর্তন করতে হয়েছে ঘটনার সাথে সম্পর্কিত নাম গুলো। কিন্তু এই কাহিনীর মূল বিষয়বস্তুকে কোন ভাবেই বিকৃত করা হয়নি, তা হলফ করেই বলা যেতে পারে। সেই সাথে একটা কথা উল্লেখ করব যে, এই উপন্যাসে ব্যবহৃত নাম গুলোর সাথে যদি বাস্তবের কোন ব্যক্তির নাম এর মিল খুঁজে পান, তবে তা সম্পুর্ন কাকতালীয় এবং লেখকের অনিচ্ছাকৃত বলে বিবেচনা করবেন। আর পরিশেষে বলব, আমাদের প্রচেষ্টা পাঠককুলের দরবারে সমাদর পেলে সার্থক হবে এই প্রয়াস।